চিংড়ি সর্বভুক প্রাণী। বয়স, ঋতু, স্থান এবং পরিবেশের কারণে এদের খাদ্যভ্যাসের পরিবর্তন ঘটে। চিংড়ি নিশাচর, নৈশভোজী ও পানির তলদেশের প্রাণী। সূর্যের আলো এড়িয়ে সাধারণত রাতেই খাবার খেতে পছন্দ করে। শ্যাওলা, বিবিধ প্রাণী কণা, পোকা-মাকড়, ছোট ছোট শামুক, ঝিনুক, ছোট ছোট মাছ, মাছের ডিম, মৃত প্রাণীর পঁচা অংশ, কেঁচো ইত্যাদি বাগদা চিংড়ির প্রধান খাদ্য। চিংড়ি স্বজাতিভোজী, যদি কখনো খাদ্যাভাব দেখা দেয় তখন সবল চিংড়ি অপেক্ষাকৃত দুর্বল চিংড়িকে ধরে খেয়ে ফেলে। এছাড়াও সম্পূরক খাদ্য হিসেবে শুকনো মাছের গুঁড়া, সয়াবিন চুর্ণ, চালের খুদ, ভুট্টা, গম চুর্ণ বা আটা প্রভৃতি গ্রহণ করে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে উভয় প্রকার খাদ্যের উৎপাদন ও নির্দিষ্ট মাত্রায় গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য পরিবেশন করা একান্ত প্রয়োজন। নতুবা চিংড়ি চাষে আশাতীত ফলন লাভ করা সম্ভব নয়। চিংড়ি চাষে সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োজনীয়তাসমূহ হলো:
ক) চিংড়ির বৃদ্ধি দ্রুততর হয়।
খ) চিংড়ির বাঁচার হার বৃদ্ধি পায়।
গ) সময়মত নির্দিষ্ট আকারের চিংড়ি আহরণ করা যায়।
ঘ) নির্দিষ্ট সময়ে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভুমিকা পালন করে।
ঙ) একক ও মিশ্রচাষে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হওয়া যায়।
দেহের পুষ্টি চাহিদা পুরণের জন্য চিংড়ি নানা ধরনের খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। খাদ্য গ্রহণের প্রকৃতিতে এরা সর্বভুক প্রাণী। খাদ্য গ্রহণে এদের কোনো বাছ-বিচার নেই। সাধারণত এরা সব ধরনের খাদ্য খেয়ে থাকে। • চিংড়ির খাদ্যকে মূলত দু'ভাগে ভাগ করা যায়, যথা- প্রাকৃতিক খাদ্য ও সম্পূরক খাদ্য।
আমাদের দেশে উন্নত সম্প্রসারিত চিংড়ি চাষ পদ্ধতিতে সাধারণত প্রাকৃতিক খাদ্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পুকুর প্রস্তুতকালীন এবং পরবর্তীতে খামার ব্যবস্থাপনার সময় জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন করা হয়। প্রাকৃতিক খাদ্য আবার দু'ধরনের-
ক) প্রাণী প্লাংকটন: ডাফনিয়া, কপিপড, ক্লাডোসেরা, রটিফারস, সাইক্লপস, ব্রাইন শ্রিম্প ইত্যাদি।
খ) উদ্ভিদ প্লাংকটন: সবুজ শেওলা, নাভিকুলা, ডায়াটমস, সুতাকার শেওলা ইত্যাদি।
চিত্র-৩.১: প্রাকৃতিক খাদ্য (উদ্ভিদ প্লাংকটন)
প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন কৌশল: পোনা মজুদের পূর্বে পানিতে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন (প্লাংকটন) নিশ্চিত করার জন্য ফারমেন্টেড অটোপলিশ (রাইস ব্রান), চিটাগুড় (মোলাসেস), ইন্ট পাউডার ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
সারণি: চিটাগুড়, অটোপলিশ ও টাস্ট এর শতাংশ প্রতি মাত্রা
অন্যান্য প্রাণীর মতই সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ও দৈহিক বৃদ্ধির জন্য চিংড়ি খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। চিংড়ির অধিক উৎপাদন পাওয়ার লক্ষ্যে পুকুর/ঘেরে উৎপাদিত প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি বাহির থেকে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা অপরিহার্য। সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগের ফলে চিংড়ির দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধির পাশাপাশি অপুষ্টিজনিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। চিংড়ি প্রতিপালনের জন্য উচ্চ মাত্রায় আমিষ জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করা আবশ্যক।
চিংড়ির খাদ্যে আমিষের পরিমাণ কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ হতে হবে। চিংড়ি পোনা থেকে শুরু করে আহরণ পর্যন্ত নির্ধারিত খাদ্য তালিকা অনুযায়ী সঠিক পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। আবহাওয়ার পরিবর্তন, পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়া, পিএইচ, এ্যালকালিনিটি, লবণাক্ততা, ইত্যাদির তারতম্য ও খোলস পরিবর্তনের ওপর চিংড়ির খাদ্য গ্রহণ নির্ভর করে। লিফ্ট নেট দিয়ে পরিমিত খাদ্য গ্রহণ ও চিংড়ির স্বাস্থ্য নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করতে হবে। সম্পুরক খাদ্য ও ভাল ব্যবস্থাপনায় এক কেজি চিংড়ি উৎপাদনের জন্য ১.৩-১.৫ কেজি খাদ্য প্রয়োজন পড়ে। সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের উপকারিতা-
১) অধিক ঘনত্বে চিংড়ি চাষ করা যায়;
২) চিংড়ির মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যায়,
৩) চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি দ্রুত হয়;
৪) চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়;
৫) অল্প সময়ে চিংড়ি বিক্রয় উপযোগী হয়; এবং
৬) অল্প আয়তনের জলাশয় হতে অধিক উৎপাদন পাওয়া যায়।
চিংড়ির খাদ্য গ্রহণ, খাদ্যের প্রতি আকর্ষণ, বিভিন্ন জৈব ও পারিবেশিক অবস্থার কারণে ভিন্ন হয়। তাই খাদ্য প্রয়োগের সময় নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করতে হবে-
১) চিংড়ির গড় ওজন;
২) পানির তাপমাত্রা;
৩) প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্যতা;
৪) খাদ্যে পুষ্টির পরিমাণ, স্বাদ ও পানিতে দ্রবণের স্থায়িত্বশীলতা
৫) খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি (কতবার, সময় ও পরিমাণ) এবং খাদ্য গ্রহণের হার পর্যবেক্ষণ ;
৬) খামার পরিচালনাকারীর জ্ঞান ও দক্ষতা, এবং
৭) চিংড়ির খোলস পাল্টানোর সময়, অমাবশ্যা ও পূর্ণিমা এবং খাদ্য গ্রহণের ধরন।
খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান না থাকলে চিংড়ি চাষে নিম্নোক্ত সমস্যাসমূহের সম্মুখীন হতে হয়-
১) চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি ধীরে হবে;
২) বিভিন্ন উপাদানের অভাবের কারণে দেহে অস্বাভাবিকতা দেখা দিবে;
৩) চাষকালিন সময় দীর্ঘায়িত হবে ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে ও উৎপাদন কমে যাবে;
৪) চিংড়ি রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
খাদ্য প্রয়োগের হার কম হলে, সাধারণত নিম্নোক্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়:
১) সকল চিংড়ি সমানভাবে খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে না;
২)চিংড়ি সমহারে বৃদ্ধি না হওয়ায় বিভিন্ন আকারের হবে;
৩) স্বজাতিভোজিতা (ক্যানাবলিজম) বৃদ্ধি পাবে,
৪) রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, এবং
৫) সর্বোপরি উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং খামার মালিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাদ্য প্রয়োগ করলে:
১) অতিরিক্ত খাদ্য প্রয়োগ করলে অব্যবহৃত খাদ্য পঁচে পানি নষ্ট করে পরিবেশ দূষিত করবে;
২) মাটি ও পানির চাষপোযোগী উপাদানসমূহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে;
৩) চিংড়ির বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে, এবং
৪) চিংড়ি রোগাক্রান্ত হয়ে ব্যাপক মড়ক হতে পারে।
আমাদের দেশে প্রাপ্য চিংড়ির সম্পুরক খাদ্য তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের উপাদান ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ সমস্ত উপাদান সঠিক মাত্রায় মিশ্রণের মাধ্যমে সম্পুরক খাদ্য তৈরি করা যায়। চিংড়ির স্বাস্থ্য ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ বা রাসায়নিক দ্রব্য কোনো অবস্থাতেই সম্পূরক খাদ্য তৈরির সময় ব্যবহার করা উচিত নয়। চিংড়ির খাদ্য উপাদানসমূহ হলো-
ক. আমিষ জাতীয় খাদ্য উপাদান: ফিশ মিল, মিট/বোন মিল, রেশমকীট মিল, চিংড়ির গুড়া, কাঁকড়ার গুড়া, ব্লাড মিল, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, সয়াবিন মিল / খৈল, নারিকেলের খৈল, বাদামের খৈল ইত্যাদি ।
খ. তৈল জাতীয় খাদ্য উপাদান: সয়াবিন তেল, মাছের তেল, সরিষার খৈল, তিলের খৈল ইত্যাদি।
গ. শর্করা জাতীয় খাদ্য উপাদান: চালের কুঁড়া, গমের ভূষি, গমের আটা, ভুট্টার আটা, চিটাগুড়, ক্ষুদিপানা, কুটিপানা, হেলেঞ্চা, বাঁধাকপির পাতা ইত্যাদি।
বাগদা চিংড়ির উপযোগী কৃত্রিম খাদ্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো:
ক. খাদ্য সহজেই গ্রহণযোগ্য হওয়া প্রয়োজন।
খ. সহজেই পরিপাক উপযোগী।
গ. চিংড়ির খাদ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ আমিষ, শর্করা, চর্বি, খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন, খনিজ পদার্থ মিনারেল থাকা আবশ্যক।
ঘ. খাদ্যে পুষ্টির অপচয় রোধকল্পে প্রস্তুতকৃত পিলেট খাবার যতটা সম্ভব শক্ত হওয়াই শ্রেয়। পিলেট তৈরির জন্য ব্যবহৃত বাইন্ডার চিংড়ির জন্য যেন ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।
চিত্র-৩.২: বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপাদান ও চিংড়ির পিলেট খাদ্য
শ্রিম্প পিলেট তৈরির ক্ষেত্রে পিলেটের আকার ও পুষ্টিগত বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হলো:
সারণি : পিলেটের আকার ও সাধারণ পুষ্টিগত বৈশিষ্ট্য
সম্পূরক খাদ্য তৈরিতে খাদ্য উপকরণগুলোর শতকরা হার অনুযায়ী পরিমাপ করে ভালো করে মিশ্রিত করতে হয়। মিশ্রণের পরিমাণ নির্ভর করে খামারের আয়তন অনুযায়ী কি পরিমাণ খাদ্য তৈরি করা হবে তার ওপর। উপকরণগুলো যথাসম্ভব চালনি দিয়ে চেলে নেয়া উচিত যাতে উপাদানগুলো সঠিকভাবে মিশ্রিত হয়। মিশ্রণকে শক্ত বড়ি বা পিলেট আকারে তৈরি করার জন্য বাইন্ডিং এজেন্ট হিসেবে চিটাগুড় বা বাইন্ডার পানিতে মিশিয়ে গরম করে নেয়া হয় এবং ক্রমাগত মিশ্রিত করে আঠার মতো করে নেওয়া হয়। তারপর খাদ্য উপাদানগুলো মেশিনের মাধ্যমে পিলেট আকারে তৈরি করা হয়। এ ছাড়া ভেজা পদ্ধতিতেও চিংড়ি খামারে খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে মিশ্রিত সম্পূরক খাদ্য প্রতি দিনের মাত্রা বা পরিমাণ অনুযায়ী পানিতে এমনভাবে মিশাতে হয় যেন ছোট গোলাকার বলের মতো তৈরি করা যায়। পরে তৈরিকৃত বল জলাশয়ের নির্দিষ্ট স্থানে আস্তে আস্তে সরবরাহ করতে হয়। বাগদা চিংড়ির সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য উদাহরণস্বরূপ নিচের সারণি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সারণি: সম্পুরক খাদ্য তৈরির জন্য ব্যবহৃত উপকরণের পরিমাণ (নমুনা)
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত চিংড়ি খাদ্য ব্যবহার
মৎস্য খাদ্য ও পশু খাদ্য আইন ২০১০ এবং মৎস্য খাদ্য বিধিমালা ২০১১ অনুসরণ করে খাদ্য উৎপাদনকারী কারখানা বা কোম্পানি থেকে খাদ্য ক্রয় করে প্রয়োগ করা যেতে পারে। উৎপাদিত খাদ্যের বস্তার উপরে লেবেলিং-এ কোন প্রজাতির চিংড়ির মান্য, খাদ্যের ধরন, খাদ্য উপাদানের তালিকা, ব্রান্ডের নাম, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও লাইসেন্স নম্বর, পুষ্টি উপাদানের বিবরণ, প্রস্তুত এবং সেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, ব্যাচ নম্বর ইত্যাদি থাকতে হবে।
তৈরি খাদ্য ও খাদ্য উপাদান গুদামজাতকরণ ও সংরক্ষণে অনুসরণীয় বিষয়াদিঃ
১) শুকনা পিলেট খাদ্য মুখ বন্ধ বায়ুরোধী পলিথিন বস্তা বা পাত্রে শুষ্ক, ঠান্ডা ও বায়ু চলাচল করা স্থানে গুদামজাত/সংরক্ষণ করতে হবে।
২) গুদাম ঘরে খাদ্য সরাসরি মেঝে বা দেয়ালের সাথে না রেখে কাঠ বা বাঁশের পাটাতনের উপরে রাখতে হবে।
৩) গুদাম ঘরে খাদ্যের বস্তা একটির উপরে একটি (১০টির বেশি নয়) রাখতে হবে।
৪) প্রতিটি সারির বস্তার মাঝে কমপক্ষে ৩০ সেমি দুরত্ব রাখতে হবে যাতে সহজেই পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে।
৫) সংরক্ষিত খাদ্যে আর্দ্রতার পরিমাণ ১০ শতাংশের নীচে রাখতে হবে (মাঝে মাঝে রোদে শুকিয়ে রাখতে হবে)।
৬) শুষ্ক পিলেট খাবার প্লাষ্টিকের ব্যাগে বায়ুশুন্য অবস্থায় বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায়।
৭) খাদ্য ও খাদ্য উপাদান সরাসরি সূর্যালোক, বৃষ্টি এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা থেকে রক্ষা পায় এমন স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে।
৮) সংরক্ষিত পিলেট খাদ্য ১-২ মাসের মধ্যে ব্যবহার করে ফেলা উচিত। তবে খাদ্যে এন্টিফাঙ্গাল এজেন্ট/অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ব্যবহার করলে ২-৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
৯) খাদ্য গুদাম অবশ্যই ইদুর, ছুচো, বিড়াল ও তেলাপোকাসহ এ জাতীয় অন্যান্য প্রাণিমুক্ত হতে হবে।
১০) এন্টিফাঙ্গাল এজেন্ট/অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ব্যবহার করলে পিলেট খাদ্য ২-৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
১১) খাদ্য ব্যবহারে আগের খাদ্য আগে ব্যবহার এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্য ব্যবহার করা যাবে না।
চিংড়ি নৈশভোজী এবং সর্বভুক প্রাণী। এরা দিনে জলাশয়ের তলায় ও রাতে উপরে খাবারের সন্ধানে বের হয়। তাই সন্ধ্যায় খাদ্য প্রয়োগ মাত্রা সকালের চেয়ে কিছুটা বেশি হবে। পিএল এর ক্ষেত্রে সপ্তাহে একবার এবং পরবর্তীতে ১৫ দিনে একবার নমুনায়ন করে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করে খাবারের পরিমাণ ঠিক করতে হবে। খাদ্য প্রয়োগের সকল তথ্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট স্থানে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। ফিডিং ট্রে ব্যবহার করে খাদ্য গ্রহণ প্রবণতা ও খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়। লোহা, বাঁশ বা কাঠের ফ্রেমের নীচে মশারির বা পলিষ্টার কাপড় দিয়ে ফিডিং ট্রে বা খাদ্যদানী তৈরি করা যেতে পারে।
সাধারণত ৩০ শতাংশ পুকুরে ২টি, ৬০ শতাংশ পুকুরে ৪টি এবং ১০০ শতাংশে ৬-৮টি ট্রে ব্যবহার করা উত্তম। ট্রে সাধারণত পাড়ের বকচর অথবা ঢালে স্থাপন করতে হবে। খাদ্য ট্রেতে উচ্ছিষ্ট খাবার থাকলে পরবর্তী খাদ্য প্রয়োগকালে খাবারের পারিমাণ কম করতে হবে এবং খাবার শেষ হয়ে গেলে পরবর্তীতে পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। খাবার ট্রে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
সারণি: খাদ্যের প্রকার, প্রয়োগ হার, প্রয়োগমাত্রা ও সময় এবং প্রয়োগ পদ্ধতি
খাদ্যের প্রকার | প্রয়োগ হার | প্রয়োগ মাত্রা ও সময় | প্রয়োগ পদ্ধতি |
---|---|---|---|
পিএল-এর (নার্সারি) খাদ্য (পাউডার, মেশ ও সুক্ষ দানাদার খাদ্য) | চিংড়ির মোট দেহ ওজনের ১৫-১০% | দৈনিক ৩-৪ বার (সকাল, সন্ধ্যা ও রাত | পুকুরের চারদিকে ৫-৭টি নির্দিষ্ট জায়গায় পাড়ের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে। |
জুভেনাইলের (স্টার্টার) খাদ্য (ক্র্যাম্বল/ ফ্লেক/দানাদার খাদ্য) (০.৮-২.০ মিমি) | চিংড়ির মোট দেহ ওজনের ১০-৬% | দৈনিক ২-৩ বার (সকাল, সন্ধ্যা ও রাত) | পুকুরের চারদিকে ৫-৭টি নির্দিষ্ট জায়গায় পাড়ের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে অথবা ট্রেতে রেখে প্রয়োগ করতে হবে। |
খাবারযোগ্য চিংড়ির খাদ্য (গ্রোয়ার (পিলেট/ দানাদার খাদ্য) (২.০-৪০ মিমি) | চিংড়ির মোট দেহ ওজনের ৫-২.৫% | দৈনিক ২ বার (সকাল ও সন্ধ্যা বেলা) | পুকুরের চারদিকে ৪-৬টি নির্দিষ্ট জায়গায় পানির ১-২ ফুট নিচে চাটাই বা ট্রেতে রেখে প্রয়োগ করতে হবে। |
সারণি: চিংড়ির ওজন অনুযায়ী খাদ্য প্রয়োগের হার
চিংড়ির প্রতিদিনের খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সূত্রটি হলো: প্রতিদিনের খাদ্যের পরিমাণ মজুদকৃত সোনার সংখ্যা x বাঁচার হার (%) x পড় দেহের ওজন x দেহ ওজন অনুসারে খাদ্য প্রয়োগ মাত্রার হার (%)। |
চিত্র-৩.৪: ঘেরে ফিডিং ট্রের মাধ্যমে খাদ্য পরীক্ষা
চিংড়ির বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যের পরিমাণও বাড়তে থাকে। চিংড়ির বয়স অনুসারে খাদ্য প্রয়োগের পরিমাণ নিচের সারণিতে দেখানো হলো।
সারণি: চিংড়ির বয়স অনুসারে প্রতিদিনের খাদ্যের পরিমাণ
খাদ্যের প্রকৃতি অনুসারে চিংড়ির পুকুরে বা জলাশয়ে তিন ভাবে খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রয়োগ পদ্ধতিসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো।
সারণি: খাদ্যের প্রকৃতি অনুসারে প্রয়োগ পদ্ধতি
ক্রম | প্রয়োগ পদ্ধতি | খাদ্যের প্রকৃতি | সুবিধা-অসুবিধা |
---|---|---|---|
০১ | ছিটিয়ে প্রয়োগ | কুঁড়া মিশ্রিত খাবার | এ পদ্ধতি চিংড়ির নার্সারির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিন্তু চারা বা মজুদ পুকুরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এতে অতিরিক্ত খাবার পুকুরের পানি দূষিত করে এবং খাদ্যের অপচয় হয়। |
পিলেট খাবার | পিলেট খাবারও পুকুরের কিনারে ছিটিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় ছিটানো পদ্ধতির চেয়ে খাদ্য অপচয় কম হয়। ধান ক্ষেতে চিংড়ির চাষ কিংবা পুকুরে স্বল্প পানি থাকা অবস্থায় বা ঘেরে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। | ||
০২ | খাবার ট্রে বা ব্যবহার পদ্ধতি পাত্ৰ | ভেজা বা পিলেট খাবার | পুকুরের বিভিন্ন স্থানে খাবার ট্রে-এর পাত্র ব্যবহার করে খাদ্য পরিবেশন করা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় খাদ্য অপচয় কম হয় এবং অতি সহজেই অতিরিক্ত খাবার সরিয়ে ফেলা যায়। অপরদিকে অতি সহজেই চিংড়ির খাদ্যের চাহিদা নির্ণয় করা যায়। |
০৩ | সামান্য পানিতে বুরা খাবার মিশিয়ে দলাকৃতির খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি | ঝুরা খাবার | এ পদ্ধতিতে দলাকৃত খাদ্যগুলো পুকুরের স্বল্প গভীর এলাকায় ছুড়ে দিতে হয়। এ প্রক্রিয়ায়ও খাদ্যের অপচয় বেশি হয়ে থাকে এবং পানি দূষিত হতে পারে। |
ফিডিং ট্রে: চিংড়ি পোনা একটু বড় হলে অর্থাৎ মজুদকৃত পোনার বয়স ৪ সপ্তাহ হলে ফিডিং ট্রে থেকে পোনার বাঁচার হার ও গড় ওজন জেনে খাদ্য সরবরাহের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। ফিডিং ট্রে দেখতে বর্গাকার বা গোলাকার হয়ে থাকে এবং ট্রে বাঁশ বা বেত দিয়ে তৈরি করা যায়। পুকুর বা ঘেরে কয়টি ট্রে স্থাপন করতে হবে তা নির্ভর করে পুকুরের আয়তনের ওপর। সাধারণত প্রতি হেক্টর আয়তনের পুকুরে ৬-৮টি ফিডিং ট্রে ব্যবহার করা হয়। ফিডিং ট্রে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য নিচের সারণি অনুসরণ করা যেতে পারে।
চিংড়ি নিশাচর প্রাণী এবং এরা সাধারণত রাতে খাবার গ্রহণ করে থাকে। এ কারণেই চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে খাদ্য পরিবেশন সন্ধ্যা ও ভোর বেলায় করা শ্রেয়। চিংড়ি সাধারণত একই পরিমাণ খাবার খায় না এজন্য প্রতিবার খাদ্য প্রয়োগের সময় ট্রে বা পাত্রে অতিরিক্ত খাদ্য থাকলে তা তুলে ফেলতে হয় এবং শেষ হয়ে গেলে খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হয়।
চিত্র-৩.৬: চিংড়ি ঘেরে ছিটিয়ে খাবার প্রয়োগ
নিম্নমানের খাদ্য এবং খাদ্যের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার চিংড়ি ও ভোক্তার উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সঠিক খাদ্য নির্বাচনে চাষির করণীয়-
১) কেবলমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎসের খাদ্য ব্যবহার।
২) খাদ্যের উৎস নির্বাচনে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে।
৩) ব্যবহৃত উপাদানের গুণগতমান ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে।
৪) স্থানীয়ভাবে খাদ্য প্রস্তুতকালীন সময়ে অনুসরণীয় সতর্কতা অবলম্বন।
৫) কেবলমাত্র ক্ষতিকর জীবাণু ও রাসায়নিকমুক্ত উপাদান ব্যবহার করতে হবে।
৬) ৰাসি ও ছত্রাকযুক্ত উপাদান ব্যবহার করা যাবে না।
৭) মেয়াদ উত্তীর্ণ কোন উপাদান ব্যবহার করা যাবে না।
৮) স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে ও জীবানুযুক্ত সরঞ্জামের সাহায্যে খাদ্য তৈরি করতে হবে।
৯) খাদ্য তৈরিতে নিয়োজিত ব্যক্তি রোগযুক্ত হতে হবে।
১০) আমিষজাতীয় কাঁচা খাবার ভালভাবে সিদ্ধ করতে হবে।
১১) তৈরি খাবারের সবটুকু একবারে ব্যবহার করতে হবে।
১২) কেবলমাত্র অনুমোদিত ঔষধ অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
১৩) কাজ শেষে অব্যবহৃত উপাদানসমূহ দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে এবং আসবাবপত্র ভালভাবে জীবাণুমুক্ত ও পরিষ্কার করতে হবে।
খাদ্য সংরক্ষণের সময় অনুসরণীয় সতর্কতা:
১) মেয়াদ উত্তীর্ণ, ভেজা বা খারাপ অবস্থায় সরবরাহকৃত খাদ্য কখনই ব্যবহার করা যাবে না।
২) কখনই ছত্রাকযুক্ত খাদ্য চিংড়িকে খাওয়ানো যাবে না।
৩) সঠিকভাবে লেবেল লাগিয়ে খাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
৪) পরিষ্কার, শুষ্ক ও শীতল স্থানে খাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে।
৫) সকল ধরনের ক্ষতিকর প্রাণী ও কীট পতঙ্গ থেকে খাদ্যকে নিরাপদ রাখতে হবে।
৬) সংরক্ষণ স্থানে কোন কীটনাশক, সার, তেল, মবিল ও অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি রাখা যাবে না।
৭) সংরক্ষণের সময় ফাষ্ট-ইন ফাষ্ট-আউট নীতি অনুসরণ করতে হবে।
৮) যথাযথ রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে।
৯) ঔষধ মিশ্রিত খাদ্যকে স্বাভাবিক খাদ্য থেকে নিরাপদ দুরত্বে পৃথকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
১০) কাঁচা খাবার, যেমন- শামুক ও ঝিনুকের মাংস, মরা মাছ, মরা প্রাণীর মাংস ও নাড়ী-ভুড়ী, স্কুইড, কাঁকড়া চূর্ন, ইত্যাদি সিদ্ধ করে ব্যবহার করলে সম্ভাব্য রোগ-জীবাণু (ভাইরাস, Salmonella, Viblio cholerae, Ecoil) সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে।